• হোম > আইন-অপরাধ | বাংলাদেশ > বুয়েট শিক্ষকের নাম প্রশ্নফাঁস চক্রে

বুয়েট শিক্ষকের নাম প্রশ্নফাঁস চক্রে

  • শনিবার, ২০ নভেম্বর ২০২১, ০৮:৫১
  • ৪৫৯

 বুয়েট শিক্ষকের নাম প্রশ্নফাঁস চক্রে

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান নিখিল রঞ্জন ধর। খন্ডকালীন হিসেবে তিনি আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও (এইউএসটি) কাজ করতেন। কিন্তু যখন থেকে এইউএসটি রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার দায়িত্ব পেল, আশ্চর্যজনকভাবে তখন থেকে ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করে নিখিল রঞ্জনের ব্যাংক হিসাব। কীভাবে স্বল্প সময়ে নিখিল রঞ্জন এত ধন-সম্পদের মালিক হলেন, তা খতিয়ে দেখতে গিয়ে বেরিয়ে আসছে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস চক্রের সদস্য হিসেবে নাম এসেছে এই শিক্ষকের। যদিও নিখিল রঞ্জন নিয়োগ পরীক্ষা কমিটিতে ছিলেন না। কিন্তু সূত্র বলছে, কমিটিতে না থাকলেও তিনি প্রশ্ন ছাপার দিন সকাল থেকে ভোর পর্যন্ত আহছানিয়া মিশনের ঢাকার আশুলিয়ার ছাপাখানায় অবস্থান করতেন। ফেরার সময় দুই কপি প্রশ্ন তিনি সঙ্গে আনতেন। প্রশ্ন ব্যাগে ঢুকিয়ে দিতেন এইউএসটির পিয়ন দেলোয়ার। এখন শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধরকে নজরদারিতে রেখেছে গোয়েন্দা পুলিশ।

অনুসন্ধান সূত্র বলছে, ২০১৪ সাল থেকে গত ছয় বছরে নিখিল রঞ্জন ধরের একটি ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। এ ছাড়া শেষ তিন বছরে তিনি সঞ্চয়পত্র কিনেছেন ১ কোটি ৮২ লাখ টাকার।  অনুসন্ধান ও প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া ১১ জনের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহাদত হোসেন সুমা বলেন, প্রশ্নফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে আমরা ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছি। এর মধ্যে কয়েকজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। প্রশ্নফাঁসে বুয়েট শিক্ষকের জড়িত থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রশ্নফাঁসে জড়িত বিভিন্ন জনের নাম উঠে এসেছে। আমরা বিষয়টি যাচাই-বাছাই করছি। যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়ার টেন্ডার এনে দেওয়াসহ এইউএসটির বিভিন্ন কাজ করে দিতেন বুয়েট শিক্ষক নিখিল। তিনি পরীক্ষা কমিটির কেউ না হলেও তার তত্ত্বাবধানেই প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও পরীক্ষা নেওয়া হতো। তাই ছাপা শেষ হওয়ার পর তিনি দুই কপি প্রশ্ন ব্যাগে করে নিয়ে আসতেন। বিষয়টি নিয়ে পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে গত বৃহস্পতিবার দীর্ঘ মিটিং হয়। এই বিষয়ে দ্রুতই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।

বিষয়টি নিয়ে এইউএসটি কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে উল্লেখ করে এক ডিবি কর্মকর্তা বলেন, পরীক্ষা কমিটির কেউ না হয়েও কীভাবে একজন বুয়েট শিক্ষক পরীক্ষার সব বিষয়ে সম্পৃক্ত থাকতেন? এমনকী প্রশ্নপত্র ছাপার মতো স্পর্শকতার জায়গায় তিনি সব সময়ই থাকতেন। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

আহছানিয়া মিশন প্রেসের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাদের ছাপাখানায় সিসি ক্যামেরাসহ ন্যূনতম নিরাপত্তাব্যবস্থাও নেই। আর সেটারই সুযোগ নিয়েছে প্রশ্নফাঁসকারীরা। গত ২ নভেম্বর আহছানিয়া মিশন ছাপাখানায় সমন্বিত পাঁচ ব্যাংকের প্রশ্নপত্র ছাপা হয়। সেদিন সকাল থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত নিখিল রঞ্জন ওই ছাপাখানায় ছিলেন। আসার সময় প্রশ্নের দুটি কপি তিনি নিয়ে যান। জানা গেছে, প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় গ্রেপ্তার এইউএসটির পিয়ন দেলোয়ার হোসেন জিজ্ঞাসাবাদে নিখিল রঞ্জন ধরকে প্রশ্ন দেওয়ার ব্যাপারে জানিয়েছেন। আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতেও তিনি ওই বুয়েট শিক্ষকের নাম বলেছেন। দেলোয়ার তার জবানবন্দিতে বলেন, তিনি ২০১৬ সালের নভেম্বরে এইউএসটির ট্রেজারার কাজী শরিফুল আলমের অফিস পিওন হিসেবে চাকরি পান। কয়েক মাস পর জানতে পারেন, ব্যাংকসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন ছাপা ও পরীক্ষার টেন্ডার পেয়েছে বিশ^বিদ্যালয়। ট্রেজারার শরিফুল আলম পরীক্ষা কমিটিতে থাকায় তাকে প্রশ্ন ছাপার বিভিন্ন কাজে নেওয়া হতো। ফলে প্রায় নিয়মিতই তিনি আশুলিয়ায় আহছানিয়া মিশনের ছাপাখানায় যেতেন। নজরদারি ও নিরাপত্তা না থাকায় তিনি লুকিয়ে প্রশ্ন নিয়ে বের হতেন। তাকে সহযোগিতা করতেন এইউএসটির টেকনিশিয়ান মুক্তারুজ্জামান এবং ল্যাব সহকারী পারভেজ মিয়া। এভাবে তিনি পাঁচ-ছয়বার প্রশ্ন ছাপাখানা থেকে নিয়ে এসেছেন। তাদের সঙ্গে শ্যামল নামে একজন থাকত। এ ছাড়া এইউএসটির এলডিসি হারুনুর রশিদ এবং নিজের ভগ্নিপতি মুবিন উদ্দিনকেও প্রশ্ন এনে দিয়েছেন।

স্বীকারোক্তিতে দেলোয়ার আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পরীক্ষার টেন্ডারগুলো আনতেন বুয়েটের শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধর। তিনিই সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্রতিবার প্রশ্ন ছাপার পর দুই সেট তিনি ব্যাগে ঢুকিয়ে নিতেন। দেলোয়ার নিজেও অনেকবার তার ব্যাগে প্রশ্ন ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কোনো প্রশ্ন বা শব্দ করলে চাকরি খেয়ে ফেলবেন বলে দেলোয়ারকে হুমকি দিয়েছিলেন নিখিল রঞ্জন।

এদিকে গোটা বিষয়টি নিয়ে নিখিল রঞ্জন ধরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ছাপাখানায় থাকার বিষয়টি  কাছে স্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, মূলত এইউএসটি কর্তৃপক্ষের ডাকে তিনি ছাপাখানায় যেতেন। আগের প্রশ্নপত্র ছাপার সময়ও গেছেন। পরীক্ষা কমিটিতে না থেকেও কেন যেতেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, মূলত পরীক্ষার সিটপ্ল্যান করতাম, অন্য শিক্ষকরাও থাকতেন। সবাই মিলে একসঙ্গে সিটপ্ল্যান তদারক করতাম।

পিয়ন দেলোয়ারের দেওয়া প্রশ্ন ব্যাগে ঢোকানোর ব্যাপারে তিনি বলেন, ছাপার পর প্রশ্নে ভুল আছে কিনা আমি সেটা দেখতাম। প্রশ্ন কোথায় রাখব ভেবে ব্যাগেই রাখতাম। ফেরার সময় সেটা বর্জ্য হিসেবে সেসব প্রশ্ন সিলগালা করে দিতাম। পরীক্ষার আগে-পরে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকার দেনদেন বেড়ে যাওয়া ও বিপুল অঙ্কের লেনদেনের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকতা করি। সেই বেতনের টাকা ব্যাংকে লেনদেন হয়েছে ও সেটা দিয়েই সঞ্চয়পত্র কিনেছেন।

গত ৬ নভেম্বর থেকে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে চাকরির প্রশ্নফাঁস চক্রের ১১ জনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। এর মধ্যে গত ৬ নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় মোক্তারুজ্জামান রয়েল, শামসুল হক শ্যামল, জানে আলম মিলন, মোস্তাফিজুর রহমান মিলন ও রাইসুল ইসলাম স্বপনকে। পরের দিন গ্রেপ্তার হয় সোহেল রানা, এমদাদুল হক খোকন ও এবিএম জাহিদ। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে পাঁচজনই বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা। সর্বশেষ ১৭ নভেম্বর রাতে রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এই চক্রের অন্যতম হোতা দেলোয়ার, পারভেজ ও রবিউল নামে তিনজনকে। তারা তিনজনই এইউএসটির কর্মচারী। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে চারজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

সূত্র: আমাদের সময়.কম


This page has been printed from Daily Jubokantho - https://www.jubokantho.com/114940 ,   Print Date & Time: Tuesday, 17 June 2025, 09:38:32 AM
Developed by: Dotsilicon [www.dotsilicon.com]
© 2025 SAASCO Group