চাপ নিতে হয় না, দিতে হয়- সাকিব যেন এই কৌশলটাই নিলেন সংবাদ সম্মেলনে। ভারতীয় সাংবাদিকদের বুঝিয়ে দিলেন, ‘টেনশন লেনে কা নেহি, দেনে কা হায়।’ আজকের ম্যাচে ভারতকে ফেভারিটের তকমা দিয়ে নিজেদের আন্ডারডগ বানিয়ে সব ধরনের চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করলেন সাকিব। প্রচ্ছন্ন একটা হুমকি ছুড়ে দিয়ে প্রতিপক্ষকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘বাংলাদেশ জিতলে আপসেট হবে।’ সেই আপসেটই করতে চান তাঁরা। অর্থাৎ অ্যাডিলেডে ভারতকে অঘটন উপহার দিতে চান সাকিব। এবারের টি২০ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ে যেমন পাকিস্তানকে, আয়ারল্যান্ড ইংল্যান্ডকে, স্কটল্যান্ড ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আর নামিবিয়া শ্রীলঙ্কাকে বিস্ময় উপহার দিয়েছে; বাংলাদেশ দলও চায় ভারতকে তেমন একটা কিছু উপহার দিতে। যে দলের সামনে এত প্রেরণাদায়ক দৃষ্টান্ত গড়াগড়ি খাচ্ছে, ভালো খেলতে বাইরে থেকে অনুপ্রেরণা খোঁজার প্রয়োজন নেই তাদের। বরং ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলে ভারতকে হারালে সেটা হবে বোনাস। ২০১৫ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে অ্যাডিলেড ওভালে যেমন তারা ইংল্যান্ডকে বিদায় করে দিয়ে বোনাস নিয়ে উন্নীত হয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনালে। ২০১৫ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলা দলের মাত্র তিনজন- সাকিব আল হাসান, সৌম্য সরকার ও তাসকিন আহমেদ রয়েছেন বর্তমান টি২০ দলে। বাকিদের খেলার অভিজ্ঞতা না থাকলেও সোনালি জয়ের সাক্ষী হয়েছিলেন টিভিতে খেলা দেখে। মাহমুদউল্লাহর ১০৩, সৌম্যর প্রভাব ফেলা ৪০ রানের ইনিংস ও মুশফিকুর রহিমের নান্দনিক ৮৯ রানের ঘটনা- এই দলের সবারই মুখস্থ। রুবেল হোসেনের ম্যাজিক বোলিং স্পেলের কথা ভোলেননি কেউই। মাহমুদউল্লাহ-মুশফিকের কেউ টি২০ বিশ্বকাপে না থাকলেও অ্যাডিলেডে নাজমুল হোসেন শান্ত, লিটন কুমার দাসদের কাছে ভালো খেলার প্রেরণা হয়ে থাকছেন। ভারতের বিপক্ষে আজকের ম্যাচটি তাই ভিন্ন সংস্করণের হলেও সাকিবদের জন্য প্রেরণার উৎসব ক্রিকেট এবং অ্যাডিলেড ওভাল। যেখানে চাপহীন থেকে ভালো ক্রিকেট খেলে দেশের মানুষকে আরেকটি ঐতিহাসিক জয় উপহার দেওয়াই ইচ্ছে ঘুড়ি উড়িয়েছে ক্রিকেটারদের আবেগ।
স্যার ব্র্র্যাডম্যানের স্মৃতিবিজড়িত অ্যাডিলেড ওভাল ক্রিকেট ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। যেখানে ভারতীয় দলের ক্রিকেটারদের রোমাঞ্চিত হওয়ার মতো অনেক রেকর্ডই রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের একমাত্র সম্বল একটি ঐতিহাসিক জয়। যেটাকে আঁকড়ে ধরে ভালো কিছু করার স্বপ্ন দেখছেন সাকিবরা। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে সেই জয়ের কথা মনে করিয়ে দিতেই বাংলাদেশ অধিনায়ক বললেন, ‘অবশ্যই ভালো স্মৃতি। ভালো স্মৃতিগুলো সব সময় অনুপ্রেরণা জোগায়। আশা করি, ওই স্মৃতিগুলো একটু হলেও সাহায্য করবে।’ তবে এসব ছাপিয়ে গেল সাকিবের নিজেদের আন্ডারডগ দাবি করার ঘটনা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে আরও যে কথা তিনি বললেন, সেটা সত্যিই বিস্ময়কর। ভারতের কাঁধে সব চাপ চাপিয়ে দিতেই কিনা বাঁহাতি এই ব্যাটার একটি ব্যাখ্যা দিলেন, ‘ভারত ফেভারিট দল, তারা এখানে বিশ্বকাপ জিততে এসেছে। আমরা ফেভারিট না, বিশ্বকাপ জিততেও আসিনি। আমরা এটা ভালোভাবেই জানি, যদি ভারতকে হারাই সেটা হবে আপসেট; আমরা নিজেদের সেরা ক্রিকেট খেলে সেটাই করতে চাই।’
অস্ট্রেলিয়ায় চলমান টি২০ বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ দলটাকে খুবই নড়বড়ে দেখাচ্ছিল। এশিয়া কাপ এবং নিউজিল্যান্ডের ত্রিদেশীয় সিরিজের সব ম্যাচ হেরে যাওয়ায় ভীষণ চাপে ছিলেন ক্রিকেটাররা। ব্রিসবেনের প্রস্তুতি ম্যাচে আফগানিস্তানের কাছে হেরে যাওয়ার ঘটনা ছিল আরও পীড়াদায়ক। সেই বাংলাদেশ দলই সুপার টোয়েলভের গ্রুপ পর্বে তিনটি ম্যাচ খেলে জিতেছে দুটিতে। নেদারল্যান্ডস আর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয় দুটি এলেও রেকর্ড গড়া হয়ে গেছে সাকিবদের। টি২০ বিশ্বকাপের মূল পর্বে নিজেদের ছাপিয়ে গেছেন তাঁরা। তাই বাকি দুই ম্যাচের একটি জিততে পারলেও পরিতৃপ্তির হাসি হাসবেন সাকিব, ‘পরবর্তী লক্ষ্য হলো দুটো ম্যাচে খুবই ভালোভাবে খেলা। যদি কোনো ম্যাচ জিততে পারি, সেটা আপসেট হিসেবেই গণ্য হবে। সেই আপসেটটা যদি করতে পারি, তাহলে আমরা খুশি হবো। আর না করতে পারলেও খুব বেশি কিছু বলার নেই। কারণ, বাকি দুই দল আমাদের থেকে অবশ্যই ভালো। তবে আমরা ভালো খেললে, দিনটি আমাদের হলে কেন জিততে পারব না! এই বিশ্বকাপে আমরা দেখেছি আয়ারল্যান্ড ইংল্যান্ডকে, পাকিস্তানকে জিম্বাবুয়ে হারিয়ে দিয়েছে। সুতরাং ও রকম একটা রেজাল্ট হলে আমরা অবশ্যই খুশি হবো।’
ভারতের বিপক্ষে অ্যাডিলেডের আজকের ম্যাচটি নিয়ে এই যে আলোচনা, অস্ট্রেলিয়ার নানা প্রান্ত থেকে সমর্থকদের ভিড় করা, স্মৃতি হাতড়ে প্রত্যাশার বেলুন ওড়ানো- এসবের কোনো মানে থাকবে না, বৃষ্টিতে ম্যাচটি পরিত্যক্ত হলে। অলক্ষুণে এই চিন্তার পেছনে কারণও রয়েছে। এই শহরে কয়েক দিন ধরেই তো কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে আকাশ। ভারত, পাকিস্তানের সঙ্গে গ্রুপের শেষ দুটি ম্যাচ খেলতে সোমবার বাংলাদেশ দল অ্যাডিলেডে এসেছে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। গতকাল দিনভর রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরি হোটেলের জানালা দিয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। আজও বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। অস্ট্রেলিয়ার বসন্তের এই বৃষ্টি এতটাই রোমান্টিক, কখন আসে, কখন থেমে যায়- বোঝা যায় না। তাই বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচটি কার্টেল ওভারে হলেও হতে পারে। ভারতের কোচ রাহুল দ্রাবিড় জানান দিয়ে গেছেন, কার্টেল ওভারের গেম খেলতে প্রস্তুত তারা। বাংলাদেশ দলও হিসাব-নিকাশ করে রণকৌশল সাজিয়ে অপেক্ষা করছে প্রকৃতির খেয়াল বোঝার জন্য। আয়োজক, সমর্থক, সাংবাদিক- সবাই একই উদ্দেশ্য নিয়ে অপেক্ষা করছে আজ সন্ধ্যায় অ্যাডিলেডে ঝুমবৃষ্টি হবে, নাকি ক্রিকেট মাঠে বিশ্বকাপের চার-ছক্কার বৃষ্টি ঝরবে ওভালে।